পাক-ভারত উত্তেজনা চরমে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কাশ্মীর সীমান্তে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলার পর পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে।

মঙ্গলবার ভোররাতে ভারতের বিমান বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের বালাকোটে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করে।

ইমরান খানের সরকার এই আক্রমণের জবাব দেওয়ার হুমকি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা ধরে অর্ধশত স্থানে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের দিকে মর্টার শেল ছোড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা।

নয়া দিল্লি দাবি করেছে, বালাকোটে চালানো বিমান হামলায় ‘৩০০ জঙ্গি’ নিহত হয়েছে। দেশটির দাবি, পাকিস্তানের জইশ-ই-মুহাম্মদ, হিজবুল্লাহ মুজাহেদিন ও লস্কর-ই-তাইয়েবার স্থাপনায় এ  হামলা চালানো হয়।

পাকিস্তান হামলা হওয়ার কথা স্বীকার করলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেছে। একই সঙ্গে এ হামলার ‘জবাব’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাকিস্তানের বিমানবাহিনী পাল্টা জবাব দিলে পিছু হটে ভারতীয় বিমান। তবে ‘পিছু হটার’ কথা স্বীকার করছে না ভারত।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দাবি, ভারতীয় বিমান তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার পর পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানের ‘তাড়া খেয়ে পালানোর’ আগে বালাকোটের কাছে বোমা ফেলে যায়। কিন্তু এতে কেউ হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর এক টুইটে বলেন, মোজাফরাবাদ সেক্টর দিয়ে ভারতীয় বিমানগুলো অনুপ্রবেশ করেছিল। ওই এলাকাটি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অংশ এবং বালাকোট শহর কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত।

এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর অন্তত ৫০টি স্থানে মর্টার শেল ছোড়ে ও গুলিবর্ষণ করে। এতে পাঁচজন ভারতীয় সেনা আহত হয়েছেন এনডিটিভি জানায়। ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই বলছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা বিকেলে সীমান্তে বেসামরিক স্থাপনা ও মানুষকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালায়।

দুই সপ্তাহ আগে ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় সে দেশের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪৬ সদস্য নিহত হয়। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ। এরপর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল।

এর মাঝেই মঙ্গলবার ভোর সাড়ে তিনটার দিকে ১২টি মিরেজ-২০০০ জঙ্গিবিমান নিয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে  জইশ-ই-মোহাম্মদের আস্তানায় অভিযান চালায় ভারতীয় বাহিনী। বিমান থেকে এক হাজার কেজি বোমা বর্ষণ করে জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের বেশ কিছু ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে নয়া দিল্লি।এ হামলার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে জরুরি এক বৈঠকের পর সেনাবাহিনী ও দেশের সাধারণ মানুষকে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতিতে তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ পরিস্থিতিতে দুই পক্ষকেই শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন দেশ হিসেবে পথচলা শুরু করলেও দুদেশের মধ্যে কাঁটা হয়ে দেখা দেয় কাশ্মীর। ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশ কয়েকবারই যুদ্ধে জড়ায়। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সে ঝগড়া এখনো চলছে।

১৯৬৫ সালে এই ইস্যুতে যুদ্ধে জড়ায় দেশ দুটি। এরপর বিভিন্ন সময় নানা ইস্যুতে সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান। ভারত সব সময়ই পাকিস্তানের দিকে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছে। কিন্তু পাকিস্তান বরাবরই  তা অস্বীকার করেছে।

কিন্তু গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার পর নতুন করে শুরু উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। ওই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নয়া দিল্লির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছিল।

কাশ্মীরে সংগঠনটির আস্তানা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয় বলে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে এই অভিযানের কথা জানান।

পুলওয়ামা হামলার দায় স্বীকার করা এই জঙ্গিগোষ্ঠীটি আরও হামলার ছক কষছিল বলে অভিযোগ ভারত সরকারের। গোখলে বলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন অংশে আরও আত্মঘাতী হামলার ছক কষছে জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং এই উদ্দেশ্যে আত্মঘাতী জিহাদিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে এমন খবর পেয়েছিলাম আমরা ‘

তিনি আরো বলেন, ‘জইশ-ই-মোহাম্মদ ও অন্যরা বিশাল সন্ত্রাসী শিবির পরিচালনা করে যেগুলোতে যে কোনো সময় কয়েকশ জিহাদিকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে তারা। পাকিস্তানকে বহুবার এমন প্রমাণ দিয়ে পদক্ষেপ নিতে বলছিল ভারত। কিন্তু পাকিস্তান কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় তাদের এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল।’

বিমানবাহিনীর অভিযানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে জানানো হয়, যুদ্ধ নয়, কেবল আত্মরক্ষার্থেই প্রত্যাঘাত করেছে ভারত। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, নতুন জঙ্গি হামলার আশঙ্কা থেকেই বাধ্য হয়ে মঙ্গলবার পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গি শিবিরে আঘাত হানে ভারত।

কাশ্মীরে অভিযানের ব্যাপারে ১২টি দেশের প্রতিনিধিকে জানিয়েছে নয়া দিল্লি। মঙ্গলবার বিকেলের দিকে ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সচিব বিজয় গোখলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক এবং আসিয়ানের সদস্য ছয় দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠক করেন।এতে তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনী সীমান্ত রেখা পেরিয়ে কাশ্মীরে জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে প্রতিনিধিদের অবহিত করেন।

এদিকে ভারতের হামলার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সভাপতিত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক হয়। এরপর সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ কোরেশি।

সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদ কোরেশি বলেন, যে স্থানে ভারত হামলা চালিয়েছে; সেখানে দেশী ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ে ঘটনা দেখানো হবে। হেলিকপ্টার প্রস্তুত আছে, এখন শুধু আবহাওয়া ঠিক থাকলে রওনা হব আমরা। সারা বিশ্বকে ভারতের অপপ্রচার সর্ম্পকে জানাতে চাই।

ভারতের হামলার ব্যাপারে বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের প্রতিনিধি ওই দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে ওআইসির একটি বৈঠক শুরু হয়েছে; সেখানে ভারতের হামলার বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে।

তিনি জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ফোনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

অন্যদিকে ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির সঙ্গে বৈঠকে বসছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এই কমিটির হাতেই আছে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরেশি জানান, আজ বুধবার পাকিস্তান পার্লামেন্টে যৌথ অধিবেশন। এরপরই ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ইমরান খান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *